বাংলাদেশ একটা উন্নয়নশীল দেশ। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে । এ দেশের ব্যবসায়ের প্রায় ৮৫% ক্ষুদ্র একমালিকানা ব্যবসায়। যেখানে ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা থাকে এক ও অভিন্ন। তাই ব্যবস্থাপনার মান এবং তা উন্নয়নের বিষয়টি সেখানে কখনই তেমন গুরুত্ব পায় না । অবশিষ্ট যা বৃহদায়তন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানেও ব্যবস্থাপক নিয়োগে তাত্ত্বিক জ্ঞানের বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে। তাই যে কোনো বিষয় থেকে ডিগ্রি নিয়েই কোনো ব্যক্তি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে স্বাভাবিকভাবেই কিছু সীমাবদ্ধতায় ভোগেন । আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে ব্যবস্থাপনার মান দুঃখজনক । সরকারি কর্তা ব্যক্তিগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা দোষে দুষ্ট থাকেন । ক্ষমতা ভোগ ও তা প্রদর্শনেই তারা স্বাচ্ছন্দবোধ করেন । তাই ব্যবস্থাপনার মান উন্নত করে প্রাতিষ্ঠানিক লক্ষ্য অর্জন ও জনগণকে সেবা করার বিষয়টি কখনই গুরুত্ব পায় না। তদুপরি দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, দলীয় লেজুড়বৃত্তি, নির্লজ্জ দলীয়করণ, বিভিন্নমুখী চাপ ব্যবস্থাপনাকে সবসময়ই অসহায়ত্বের সম্মুখীন করে । এর বাইরে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা যা রয়েছে তাদের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপকদের মান উন্নয়নে কিছু কর্মসূচি নিলেও দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা নানান সমস্যার নিগড়ে বন্দী । নিম্নে কতিপয় সমস্যা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো :
১. প্রতিযোগী ব্যবসায় পরিবেশের অভাব (Lack of competitive business environment) : আমাদের দেশের ব্যবসায় জগতে এখনও কার্যত একচেটিয়া ব্যবসায় পরিবেশ বিরাজমান। অদক্ষ ব্যবস্থাপনাও এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসায় চালায় । নতুন নতুন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও প্রতিযোগী পরিবেশ গড়ে না ওঠার কারণেই এখানে ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন চিন্তা প্রবল নয় ।
২. পেশা হিসেবে মর্যাদার অভাব (Non professionalisation of managers) : উন্নত বিশ্বে ব্যবস্থাপনা পেশা হিসেবে অনেকটা মর্যাদা পেলেও আমাদের দেশে এটি এখনও পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। ফলে এ. পেশায় এমন লোকেরা সহজেই প্রবেশ করে যাদের এ বিষয়ে কোনো প্রাথমিক জ্ঞানও নেই । তাদের পরিচালিত ব্যবস্থাপনা প্রায় ক্ষেত্রেই 'হাতুড়ে' বিষয়ে পরিণত হয় । যেটাও এ দেশে ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়নে একটি বড় সমস্যা।
৩. সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অভাব (Lack of associate institution) : আমাদের দেশে ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। ব্যবসায় প্রশাসন কেন্দ্র (IBA), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট (BIM), বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (BPTAC)-এর মতো দু'একটা প্রতিষ্ঠান থাকলেও তার কার্যক্রম তেমন বিস্তৃত নয় । বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তাত্ত্বিক জ্ঞানদানের যে পাঠ্যক্রম চালু রয়েছে তাও যথেষ্ট বলা যায় না ।
৪. দক্ষ ব্যবস্থাপকের অভাব (Lack of efficient managers) : বাংলাদেশে দক্ষ ব্যবস্থাপকের তীব্র অভাব বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় । ভালো উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপক যারা রয়েছেন তাদের ভালো দিকগুলোও যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না । বরং বিরূপ প্রচারণা হয় বেশি। তাই দোষ-ত্রুটিমুক্ত একদল সৎ ও দক্ষ ব্যবস্থাপক যদি জনসমক্ষে প্রচারণা লাভের সুযোগ পেত তাহলে অনেকেই তা দেখে উদ্বুদ্ধ ও দক্ষতা অর্জনে তৎপর হতো ।
৫. আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব (Absence of modern approaches) : আমাদের দেশের মালিক, ব্যবস্থাপক, শ্রমিক-কর্মচারী সবাই কার্যত গতানুগতিক মানসিকতার অধিকারী। আধুনিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সম্পর্কে তারা সচেতন নন । যে কারণে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উদ্যম, উৎসাহ, দলীয় প্রচেষ্টা, নতুন চিন্তা-গবেষণা বাস্তব অর্থেই অনুপস্থিত । ফলে স্থবিরতা ও অদক্ষতা ব্যবস্থাপনার সর্বস্তরে বিরাজমান ।
৬. প্রশিক্ষণের অভাব (Lack of training) : আমাদের ব্যবস্থাপনার মানোন্নয়নের জন্য কোনো কার্যকর প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি । ক্ষেত্রবিশেষে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও তা কার্যত তেমন ফলপ্রদ নয় । তাই ব্যবস্থাপনা বিষয়ে উন্নতির কথা কেউ ভাবলেও প্রশিক্ষণের অভাবে তাদের পক্ষে এর সুষ্ঠু প্রয়োগ সম্ভব হয় না ।
৭. শ্রমিক-ব্যবস্থাপনা সম্পর্কের অভাব (Lack of labour-management relations) : আমাদের দেশে শ্রম-ব্যবস্থাপনা সম্পর্ক কাম্য মানের নয় । অদক্ষ ও অশিক্ষিত শ্রমিক-কর্মীরা নিজের কল্যাণ সম্বন্ধে অসচেতন। ট্রেড ইউনিয়নের নামে এ দেশে যা চলছে তা ভালো কিছু নয় । বেসরকারি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে কর্মীদের সাথে যে আচরণ করা হয় তাও অত্যন্ত দুঃখজনক । এরূপ অবস্থায় দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠতে পারে না ।
৮. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা (Political instability) : রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আমাদের দেশে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রয়োগে আরেকটি বড় বাধা। আর এরূপ অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির মূল কেন্দ্র হলো শিক্ষাঙ্গন ও শিল্প এলাকা । এ ধরনের অবস্থায় মূলত ব্যবস্থাপকদের করার তেমন কিছু থাকে না । ফলে ব্যবস্থাপনা উৎসাহ হারায় এবং স্থবির ও অদক্ষ হয়ে পড়ে ।
উপসংহারে বলা যায়, ব্যবস্থাপনার সুষ্ঠু প্রয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি না হলে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় । তাই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা দূরীকরণে এ দেশের সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযোগ্য ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে ।